বিধান চন্দ্র রায়, নীলফামারী: মঙ্গা অধ্যুষিত এলাকার দুর্নাম ঘুচিয়ে গত কয়েক দশক ধরেই কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে একের পর এক চমক দেখিয়ে চলেছে দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলো। নিজ নিজ উদ্যোগে তারা বদলে দিচ্ছেন গ্রামীণ অর্থনীতির চিত্র। ঘরে ঘরে স্বাবলম্বী নারীদের সংখ্যা বাড়ছে জ্যামিতিক হারে । সেই সঙ্গে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোগ আর বাড়তি আয়ের সহজলভ্যতার কারণে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছেন প্রান্তিক পর্যায়ের জনগোষ্ঠী। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ধকল সামলানো নদী পাড়ের কৃষকরাও ধীরে ধীরে শক্ত ভিতের ওপর নিজেদের দাঁড় করাতে চেষ্টা করছেন।
নদীভাঙনে বিলীন হওয়া বহু আবাদি জমির সঙ্গে বিবর্ণ হয়ে যায় কৃষকের স্বপ্ন। সেই স্বপ্নকে আবারো জাগিয়ে তুলতে কোমর বেঁধে মাঠে নামেন কৃষক। প্রাণপণ চেষ্টায় ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা চলে। লাখ লাখ কৃষকের কষ্টের মধ্যে এখন ফুটে উঠছে হাসি।
দেশের উত্তর জনপদের নীলফামারীর সদর, জলঢাকা, ডিমলা, ডোমার ও লালমনিরহাট এবং কুড়িগ্রাম জেলায় নদী অববাহিকায় বর্তমানে জেগে উঠেছে এক হাজার ৩২৬টি চর। এসব চরে আবারো ফসল ফলিয়ে স্বাবলম্বী হবার স্বপ্ন দেখছেন লাখ লাখ কৃষক। নদী ভাঙ্গন ও বন্যার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়া কৃষকরা জেগে ওঠা চরের দিকে তাকিয়ে আবারো আগামীর স্বপ্ন দেখা শুরু করেছেন। ইতিমধ্যেই পানিশূন্য হয়ে পড়েছে উত্তরের নদীগুলো। এসব মরা নদীর বুকে একের পর এক জেগে উঠে ধু-ধু বালুচরে আবার সবুজের হাতছানি দিতে শুরু করেছে। কৃষকরা ধু-ধু বালুচরে ফসল বুনতে শুরু করেছেন। ধীরে ধীরে সবুজ হচ্ছে দিগন্ত বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল।
বিভিন্ন শাক-সবজি, ভুট্টা, লাউ, কুমড়ো, মরিচ, তিল, কাউন, চিনাবাদাম ও গমের চাষ করে নতুন উদ্যোমে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় মুখর কৃষকদের সময় কাটছে ব্যস্ততায়।
কথা হয় নীলফামারীর জলঢাকার ভাবনচুরের কৃষক বাসার মিয়ার সাথে তিনি জানালেন, আমাদের চর এলাকায় উৎপাদন বেশি হয় আমি প্রতিবছরই শাকসবজি চাষ করি ও নিজ হাতে বিক্রিও করি। আমাদের নীলফামারী জেলার মোট চাহিদার প্রায় অধিকাংশ শাক-সবজি চর এলাকায় উৎপাদন হয়। আবার চরাঞ্চলে উৎপাদিত শাক-সবজিসহ অন্য পণ্য জেলার বাহিরেও যায়।
তিস্তা চরাঞ্চলের ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন বলেন, আমি ৮-১০ বছর হলো ভুট্টা আবাদ করি অন্য বছরগুলোতে আমি দুই থেকে তিন লক্ষ টাকার ভুট্টা বিক্রি করেছি। গত বছর আমার ১৪ থেকে ১৫ লক্ষ টাকা এসেছে। এবার আশা করছি ৩০-৩৫ লক্ষ টাকা ভুট্টা বেচা – কিনা করব।
চরাঞ্চলগুলো ঘুরে দেখা যায়,অনেকে ভুট্টা রোপনে ব্যস্ত সময় পার করছেন। কেউবা লাউ, মিষ্টি কুমড়ার যত্ন নিচ্ছেন।কৃষকের আঙ্গুলে সযত্নে বুনে আসা বিজ দানা গুলো এখন পরিপূর্ণ গাছ হয়ে দাঁড়িয়েছে- কচি পাতা থেকে ফুটেছে ফুল। পুরো চরাঞ্চল ছেয়ে গেছে ফুল আর ফসলে।এখন নিরাণীর কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষিরা। সম্প্রতি ভুট্টা মরিচের দাম ভালো পাওয়ায় তৈরি হয়েছে নতুন স্বপ্ন।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক মোঃ এনামুল হক বলেন, কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। বর্তমানে চরাঞ্চল কৃষিতে বৈপ্লবিক উন্নতি করেছে। প্রচলিত কৃষি কাজের বাইরে অর্থাৎ ধান-পাট এসব চাষের বাইরে কৃষির বিভিন্ন উপখাত যেমন, মৎস্য চাষ, হাঁস-মুরগীর খামার, পশু পালন, দুগ্ধ খামার ছাড়াও বছরব্যাপী সবজি ও ফলের চাষ ব্যাপক প্রসার ঘটেছে চরাঞ্চলে।এর ফলে যেমন বহু বেকারের কর্ম সংস্থান হয়েছে, তেমনি চাঙ্গা হয়েছে উত্তরাঞ্চলের গ্রামীণ অর্থনীতি। এছাড়া গ্রামের মা-বোনরা অনেকে হাঁস-মুরগি পালন, গরু-ছাগল পালন, ভেড়া পালন, টার্কি পালন, ফলমূল, শাক-সবজি ইত্যাদি চাষের মাধ্যমে বাড়তি আয় করে অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখছেন।