সুন্দরবনে আগুন: হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য

মাত্র কদিন হলো, পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জে আনুরবুনিয়ার এলাকার বনে আগুন লেগেছে । এ পর্যন্ত গত ২২ বছরে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সুন্দরবনে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে ২৫ বার। প্রতিবারই বন বিভাগের কর্মী ও স্থানীয় জনগণ মিলে আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজটি করে থাকেন। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরাও এই আগুন নিয়ন্ত্রণে সাধ্যমত কাজ করে থাকেন। গত শনিবার দুপুরে চাঁদপাই রেঞ্জে অনুরবুনিয়ার এলাকায় বনে আগুনের কুণ্ডলী থেকে ধোয়া উঠতে দেখে জানান কর্মীরা । তবে কিভাবে আগুন লেগেছে তার তথ্য কেহই দিতে পারে নাই। সুন্দরবনের জেলে ও মৌয়ালদের কারণে আগুনের সূত্রপাত হয় বলে অনেকেরই ধারণা। তবে বনজীবীদের এ বিষয়ে দ্বিমত রয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় হেলিকপ্টার থেকে পানি ছিটানো হয়েছে। পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিস, কোস্টগার্ড এবং নৌবাহিনীর সদস্যরাও আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করেছে।

আগুন কেমন করে লেগেছে, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে বন বিভাগের তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর। প্রতিবারই সুন্দরবনে আগুন নেভাতে ২-৩ দিন সময় লাগে আর এতে প্রতিবারই সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য চরমভাবে হুমকিতে পড়ে এবং বিঘ্নিত হয়। এ পর্যন্ত খবরে প্রাপ্ত প্রায় পাঁচ একর বনভূমির জায়গা পুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে । স্থানীয়দের মতে সুন্দরবনের এলাকাটি দিন দিন উঁচু হওয়া, নদী- খাল গুলে মরে যাওয়ার কারণে নিয়মিত জোয়ার ভাটা হয় না। সারা বছর গাছের পাতা পড়ে প্রচুর হিউমাস তৈরি হয়, যাহার ফলে চৈত্র-বৈশাখ মাসে শুষ্ক মৌসুমে সুন্দরবনে আগুন লাগার ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে ।

সুন্দরবন পৃথিবীর একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। এ বনের ৬২ শতাংশ বাংলাদেশে এবং বাকি ৩৮ শতাংশ পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত। বর্তমানে সুন্দরবনের আয়তন ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার। সুন্দরবনের অপর নাম গুলো হলো -বাদাবন, গরান বন। এখানে প্রাণী প্রজাতির রয়েছে প্রায় ৩৫০ প্রজাতির উদ্ভিদ, ১২০ প্রজাতির মাছ, ২৭০ প্রাজাতির পাখি, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ সরীসৃপ এবং ৮ টি উভচর প্রাণী। সুন্দরী বৃক্ষের নামানুসারে এই বনের নাম সুন্দরবন রাখা হয়।

গুরুত্ব বিবেচনায় বনভূমিটি, স্বনামে বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছাড়াও নানান ধরনের পাখি, চিত্রা হরিণ, কুমির ও সাপসহ অসংখ্য প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত। জরিপ মোতাবেক ১০৬ বাঘ ও ১০০০০০ থেকে ১৫০০০০ চিত্রা হরিণ রয়েছে এখন সুন্দরবন এলাকায়। ১৯৯২ সালের ২১ মে সুন্দরবন রামসার স্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। সুন্দরবন থাকার কারণে ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাসের সময় উপকূলীয় অঞ্চলের জীবন ও সম্পদ বড় ধরনের ক্ষতি ও ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়। এই বনের কারণে বছরে তিন হাজার ৮৮১ কোটি টাকার সম্পদ রক্ষা পায়। জীবিকার মাধ্যমে বছরে এক হাজার ১৬১ কোটি টাকার সমপরিমাণ আর্থিক সম্পদ পাওয়প যায় এই বন থেকে। মধু,মাছ, কাঁকড়া, গোলপাতা, পর্যটক, ঔষধি গাছ ইত্যাদি সুবিধাও আমরা পাই যা আমাদের দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের অবদান রাখে। গাছ মানুষের যে উপকারগুলো করে তা হলো, অক্সিজেন, জ্বালানি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ রোধ, পানির ভারসাম্য রক্ষা ইত্যাদি সকল উপকার আমরা সুন্দরবন থেকে পাই।

২০১৪ সালে একটি তেলবাহী জাহাজ সুন্দরবনের নদীতে ডুবে গেলে অনেক এলাকা জুড়ে তেল ছড়িয়ে পড়েছিল, ফলে জীববৈচিত্র্য ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। ভাসমান তেলের কারণে শ্বাসমূলীয় উদ্ভিদগুলোর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা চরমভাবে ব্যাহত হয়েছিল। এখনো বনের ভেতর অবাধে চলছে তেল, কয়লা, রাসায়নিক সারবাহী জাহাজ। অধিক রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের জন্য। রাস্তা, রেললাইন, ব্রিজ, বাঁধ, জলাধার, খাল নির্মাণ, খনি, অরণ্যনিধন, কৃষিজমির সম্প্রসারণ, নগরায়ণ ও শিল্পায়নের জন্য। পরিবেশ দূষণের জন্য। জীবগোষ্ঠীর প্রাকৃতিক বাসভূমি বা স্বাভাবিক বাসস্থান (habitat) বিনষ্ট হওয়ার জন্য ও অতিরিক্ত শিকার করার জন্য।

বিশ্বের সব থেকে বড় ম্যানগ্ৰোভ বন সুন্দরবন । পুরো বাংলাদেশের অস্থিত্ব গুরুত্ব বহন না করলেও বৃহত্তর খুলনা অঞ্চল হুমকির মুখে পড়বে সুন্দর । বন না থাকলে ঐ এলাকার জীব বৈচিত্র বিলুপ্ত হয়ে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হবে। ঝড় জলোচ্ছ্বাস নিয়মিত হওয়ার জন্য মানুষ বাস্তুচুত্য হবে। খুলনা অঞ্চলের ফসল উৎপাদন বাধাগ্ৰস্ত্র হবে লোনা জলের কারনে।সবদিক বিবেচনা করলে বাংলাদেশের বিশাল অংশের ভালোই ক্ষতি হবে। জৈব বৈচিত্রের প্রতি হুমকি সমূহ হলো, অবাধে গাছ কেটে ফেলা , পশুপাখি শিকার করা, ফসলে অতিরিক্ত কিটনাশক ব্যাবহার করা। এরই সাথে নুতন করে যুক্ত হয়েছে সুন্দরবনের বনভূমিতে ঘন ঘন অগ্নিকান্ড ।

সুন্দরবনের প্রাকৃতিক রাজধানী সংরক্ষণ এবং বর্ধিত করা এইসব বিপদ মোকাবেলা করার জন্য এবং সম্প্রদায়ের স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধির জন্য একটি অসাধারণ প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধান। ম্যানগ্রোভ বন একটি ৫০-৬০ কিমি বাফার প্রদান করে, যা শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় বাতাস এবং ঝড়বৃষ্টির বিরুদ্ধে বাধা হিসেবে কাজ করে। সুন্দরবন আমাদেরকে শব্দ দূষণ থেকে বাঁচায়, খাবারের যোগানদাতা, কর্মক্ষেত্র তৈরি করে, ভূমিক্ষয় রোধ করে, ওষুধ তৈরিতে যোগান দেয়, অসংখ্য প্রজাতির আবাসস্থল, বাতাস পরিষ্কার রাখে, কয়েক কোটি মানুষের বাস, আবহাওয়াকে প্রভাবিত করে, আমাদেরকে শীতল রাখে, অক্সিজেন সরবরাহ করে, এবং কার্বন ডাই অক্সাইডের সংরক্ষণাগারের কাজ করে। গাছ মানুষের যে উপকারগুলো করে তাহলো, অক্সিজেন, জ্বালানি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ রোধ, পানির ভারসাম্য রক্ষা ইত্যাদি সকল উপকার আমরা সুন্দরবন থেকে পাই। তাছাড়াও মধু, মাছ, কাঁকড়া, গোলপাতা, পর্যটক, ঔষধি গাছ ইত্যাদি সুবিধাও আমরা পাই যা আমাদের দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের অবদান রাখছে।

লেখক: সমীরণ বিশ্বাস
কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ , ঢাকা।
[email protected]