মাছ চাষে ফিশ মিলের বিকল্প হতে পারে ফেলে দেওয়া পাট পাতা

ভুমিকাঃ মৎস্য চূর্ণ বা ফিশ মিল আধুনিক মাছ চাষের খাদ্য তৈরিতে প্রোটিনের প্রধান উৎস্য হিসাবে ঐতিহ্যগতভাবে ব্যবহৃত হয়েছে আসছে। কিন্তু মাছের খাদ্যের উচ্চ মূল্য, খাদ্যের মানের তারতম্য, মিশ মিলের দূস্প্রাপ্যতা এবং অনিশ্চিত সরবরাহ আমাদেরকে প্রোটিনর বিকল্প উৎস্যের সন্ধান করতে বাধ্য করছে। মাছ উৎপাদনে ৫০-৬০% এরও বেশি খাদ্যের জন্য খরচ হয়। খাদ্যের এই ব্যয় অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে যেমন খাদ্যে প্রোটিনের পরিমাণ, প্রোটিনের উৎস্য এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতি।

প্রোটিন হচ্ছে মাছের খাদ্যের মধ্যে সবচেয়ে দামী একটি উপাদান, যার অভাব হলে মাছের শারীরিক গঠন সঠিক ভাবে বিকশিত হয় না। তাই ফিশ মিলের বিকল্প উপাদানের সন্ধান এবং মাছের খাদ্যের দাম চাষীদের ব্যয় সীমার মধ্যের রাখাই মাছ চাষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মাছ চাষকে অর্থনৈতিকভাবে আরও টেকসই করার কন্য অপ্রচলিত প্রোটিনের উৎস্য বিশেষভাবে গাছ গাছালির বীজ, পাতা এবং অন্যান্য কৃষি উপজাত পণ্য / বর্জ্যসমূহ ব্যবহার করে গবেষকগণ মাছের খাদ্যের ব্যয় হ্রাসের জন্য নিরলসভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

পাট এমনই একটি অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং বিভিন্ন প্রকার খাদ্য মান সম্পূর্ণ শাক যা কর্কর্রাস গণের অন্তর্গত। এই গণের অধীনে ৪০-১০০ প্রজাতির ফুল প্রদানকারী গাছ রয়েছে যাদের সবাই কম বেশী খাদ্য মানের দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই অর্থকরী ফসলটি এশিয়া থেকে আফ্রিকা পর্যন্ত গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে ব্যাপকভাবে পাওয়া যায় যা গরীবের খাদ্য হিসাবে এবং শক্তিশালী ফাইবারের জন্য সম্ভ্রান্ত পরিবারেও সমাদৃত। তাছারা, পাট পাতা সবজি হিসাবে এশিয়া, আফ্রিকা এবং ইউরোপের অনেক দেশে মানুষ নিয়মিত ভক্ষণ করে থাকে। পাট শব্দটি সম্ভবত উড়িষ্যান শব্দ ঝুট বা জোটা থেকে এসেছে। এটি একটি খাড়া ও বার্ষিক ঔষধি ফসল যা লম্বা পাতাযুক্ত। পাট সাধারণত বেশ কয়েক রকমের হয় যেমন- টোসা, ম্যালো, জিউ’র ইত্যাদি।

পাটের পাতা বহু পুষ্টি গুণে ভরপুর যা মানুষের পুষ্টি বিধানের পাশাপাশি মাছ, মুরগি এবং গৃহপালিত প্রাণির খাদ্যের একটি সম্ভাব্য বিকল্প উপাদান হতে পারে। পাট একসময় বাংলাদেশে সোনালী আঁশ হিসাবে পরিচিত ছিল, কারণ এটি ছিল কৃষির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল। সাধারণত পাট কাটার পর হাজার হাজার টন পাট পাতা একদিকে যেমন পচিয়ে নষ্ট করা হয়, অন্যদিকে এই পচনের ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশেরও ভারসাম্য বিনষ্ট হয়। তাই এই পাতা যদি সংগ্রহ করে প্রক্রিয়াজাত করা যায় তবে পশু পাখি এবং মাছের একটি বিকল্প খাদ্য উপাদান হিসাবে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে বলে বিশেষজ্ঞগণ মত ব্যক্ত করেছেন।

পাট পাতার পুষ্টি গুণঃ


পাট পাতা সামান্য তিক্ত স্বাদের হলেও এটি অনেক পুষ্টি উপাদান, ভিটামিন এবং খনিজ লবণের উৎস্য হিসাবে কাজ করে। যদি ৮৭ গ্রাম পাট পাতা লবণ ছাড়া রান্না করা হয় তবে, ৯৪ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন কে, ০.৪৯৬ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি ৬, ২.৭৩ মিলিগ্রাম আয়রন, ২২৫ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন এ, ২৮.৭ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি এবং ০.২২২ মিলিগ্রাম কপার পাওয়া যায়। এছাড়াও পাট পাতায় প্রচুর পরিমাণে অ্যামাইনো অ্যাসিড যেমন ট্রিপটোফেন ০.০২১ গ্রাম, থ্রেওনিন ০.১১৩ গ্রাম, আইসোলিউসিন ০.১৫২ গ্রাম, লিউসিন ০.২৬৬ গ্রাম, লাইসিন ০.১৫১ গ্রাম এবং মেথিয়োনিন ০.০৪ গ্রাম পাওয়া যায়।

টেবিল ১. এক কাপ সমপরিমাণ (৮৭ গ্রাম) রান্না করা পাট শাক থেকে নিম্নলিখিত পরিমাণ পুষ্টি উপাদান এবং শক্তি পাওয়া যায়। (৩২ কিলোক্যালরি শক্তি এবং চর্বি থেকে প্রাপ্ত শক্তি ১.৫৩ কিলোক্যালরি)

পাটের স্বাস্থ্য উপকারিতাঃ


পাট একটি বার্ষিক ভেষজ উদ্ভিদ যা উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ুতে উৎপন্ন হয়। পাটের শাক উচ্চ পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ হওয়ার কারণে এটি বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যা মোকাবেলায় ব্যবহৃত হয়। নিয়মিত পাট পাতা খাওয়ার মাধ্যমে যে সমস্ত স্বাস্থ্য সুবিধা পাওয়া যায় তা নীচে তালিকাভুক্ত করা হল:

দেহের অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ রোধ করেঃ


পাট পাতায় প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন “কে” থাকে। পুষ্টির অভাব জনিত অবসন্নতা, জন্ডিস বা অ্যান্টিবায়োটিক বা অ্যাসপিরিন জাতীয় ওষুধ দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহারের ফলে লিভারে যে রক্তক্ষরণের হুমকি সৃষ্টি হয় তা এই পাট শাকের ভিটামিন হ্রাস করে। দেহে এই ভিটামিনের অভাবে গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সিস্টেমের সাথে সম্পর্কিত সমস্যা সমূহের মধ্যে রয়েছে- কোলাইটিস, দেহে রক্ত চলাচলে প্রতিবন্ধকতা এবং ক্রোহন নামক রোগ সৃষ্টি করে থাকে।

চোখের স্বাস্থ্য রক্ষায় সাহায্য করেঃ


খাদ্যের গুণগত মা্নের ঘাটতি বা পুষ্টির স্বল্পতা হ’ল চোখের বিভিন্ন রোগের মূল কারণ। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে ভিটামিন “বি-৬” অন্যান্য ভিটামিনের সাথে ফোলেটকে একত্রিত করে চোখের ব্যাধি এবং দৃষ্টিশক্তি হ্রাস রোধে সহায়তা করে থাকে। পাট পাতার মাঝে ০.৪৯৬ মিলিগ্রাম ভিটামিন “বি-৬” থাকে যা আমাদের প্রতিদিনের চাহিদার ৩৮.১৫%। পাট শাক নিয়মিত ব্যবহারে বয়সের সাথে সম্পর্কিত ম্যাকুলার অবক্ষয়সহ চোখের অনেকগুলি রোগের শুরুকে ধীর করতে সহায়তা করে বলে বিশ্বাস করা হয়।

অস্থির লেগ সিনড্রোম রোধ করেঃ


আমাদের অস্থির লেগ সিনড্রোমের অন্যতম প্রধান কারণ আয়রনের ঘাটতি। রক্তের মধ্যে লোহার নিম্ন মাত্রা এই অবস্থার একটি প্রধান কারণ। পাট শাক নিয়মিত সেবন করলে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। কারণ পাট শাকে ২.৭৩ মিলিগ্রাম আয়রন থাকে যা দৈনিক চাহিদার ৩৪.১৩%। তাছাড়া আমাদের হাত ও পায়ের মাংসপেশীর স্প্যামসও আয়রনের ঘাটতির অন্যতম প্রধান লক্ষণ।

ত্বকের স্বাস্থ্য এবং কোষের বৃদ্ধিতে সহায়তা করেঃ


ভিটামিন “এ” আমাদের দেহের ক্ষত নিরাময়ের পাশাপাশি ত্বকের পুনঃবৃদ্ধিতে সহায়তা করে। পাট শাকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন “এ” থাকে যা ত্বকের স্বাস্থ্য এবং কোষের উন্নতিতে সহায়তা করে। গবেষণায় প্রমাণিত যে ভিটামিন “এ” ব্রণের সাথে লড়াই করে ত্বকের সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উন্নতি করে থাকে। তাছাড়া ভিটামিন “এ” কোলাজেন তৈরি করে ত্বকের বলিরেখা দূর করতে সহায়তা করে।

সর্দি এবং ফ্লু থেকে প্ররিত্রাণ লাভঃ


পাট পাতায় প্রচুর ভিটামিন “সি” রয়েছে যা আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন । পাট শাকের এই ভিটামিন “সি” সর্দি-কাশি এবং ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য দেহের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অধিকন্তু, নিউমোনিয়া এবং ফুসফুসের সংক্রমণের ঝুঁকি হ্রাসেও সাহায্য করে।

দেহের কোলেস্টেরল হ্রাস করেঃ


গবেষণায় দেখা গেছে যে পাট পাতায় ০.২২২ মিলিগ্রাম তামা(কপার) পাওয়া যায় যা দেহের “খারাপ” কোলেস্টেরল (এলডিএল) এর মাত্রা হ্রাস এবং উপকারী কোলেস্টেরল (এইচডিএল) এর বৃদ্ধিতে সহায়তা করে থাকে। পাট পাতায় যে কপার থাকে তা আমাদের দৈনিক চাহিদার ২৪.৬৭%। অধিকন্তু, পাট পাতাস্থিত তামা হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের মতো কার্ডিওভাসকুলার রোগের সম্ভাবনা হ্রাস করতে সহায়তা করে।

ক্যান্সারের ঝুকি হ্রাস করেঃ


পাটে উপস্থিত ভিটামিন “বি-9” মানবদেহে ক্যান্সারের প্রকোপ হ্রাসে অতি প্রয়োজনীয় উপাদান হিসাবে কাজ করে। এটি কোলন ক্যান্সার, জরায়ুর ক্যান্সার এবং ফুসফুসের ক্যান্সারসহ বিভিন্ন প্রকার ক্যান্সারের সম্ভাবনাকে দূর করতে সহায়তা করে। পাট পাতায় ৯০ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন “বি-9” থাকে যা প্রতিদিনের চাহিদার ২২.৫০%। সুতরাং, আমাদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় পর্যাপ্ত পরিমাণে পাট শাক অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ডাক্তারগণ পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

দাঁত এবং মাড়ির স্বাস্থ্য রক্ষা করেঃ


পাট পাতায় পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্যালসিয়াম পাওয়া যায় যা আমাদের দৈনিক চাহিদার ১৮.৪০% (১৮৪ মিলিগ্রাম)। নিয়মিত পাট শাক ভক্ষণের মাধ্যমে দাঁত এবং মাড়ির স্বাস্থ্য সুরক্ষা করা সম্ভব। তাই বাচ্চাদের নিয়মিত ক্যালসিয়ামযুক্ত পাট শাক গ্রহণের অভ্যাস করা উচিত, যাতে তাদের দাঁত ও মাড়ি মজবুত থাকে।

হাঁপানির প্রকোপ রোধ করেঃ


পাট পাতায় আমাদের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত পরিমাণ ম্যাগনেসিয়াম থাকে যা আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসকে স্বাভাবিক এবং ব্রঙ্কিয়াল পেশী শিথিল করে শ্বাস-প্রশ্বাসকে নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। তাছাড়া, অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের ম্যাগনেসিয়ামের ঘাটতি জনিত শ্বাসকষ্ট থেকে পাট শাক বহুলাংশে মুক্তি দিতে পারে।

দেশ বিদেশের বিজ্ঞানীদের গবেষণাঃ


দেশ বিদেশের বহু বিজ্ঞানী স্থানীয়ভাবে উৎপন্ন উদ্ভিদের মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে গৃহ পালিত পশু পাখির খাদ্য উৎপাদন করে বাণিজ্যিক ভাবে উৎপাদিত দামী খাদ্যের বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করার চেষ্টা করছেন। তারা গাছের সবুজ পাতা, ফল, মূল এবং শিকড় দিয়ে দেশীয় পদ্ধতিতে, তুলনামূলক সস্তা কিন্তু গুণগত মান সম্পন্ন খাদ্য তৈরির মাধ্যমে বাণিজ্যিক খাদ্যের বিকল্প হিসাবে প্রয়োগ করে ভাল ফলাফল পেয়েছেন। বিজ্ঞানী লুমেনের মতে পাট পাতায় যে চর্বি, প্রোটিন, মিনারেলস এবং ভিটামিন সমূহ রয়েছে তা হাস-মুরগীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং লাভজনক উৎপাদনে ব্যাপক ভুমিকা রাখছে। সুতরাং, পাট পাতা প্রক্রিয়াজাত করনের মাধ্যমে পাউডার উৎপাদান করে প্রর্যায়ক্রমিকভাবে ফিশ মিল প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে মৃগেল মাছের পোনার খাদ্য তৈরি করে গবেষণাগারে ভাল ফলাফল লক্ষ্য করা গেছে। নিম্নে পাট পাতা প্রক্রিয়াজাত করণ করে পাউডার উৎপাদান এবং মৃগেল মাছের পোনার খাদ্য প্রস্তুত করণ প্রক্রিয়া ধারাবাহিক ভেবে বর্ননা করা হল।

পাট পাতা প্রক্রিয়াজাত করণঃ


স্থানীয় বাজার থেকে পাট শাক কিনে এনে তা ভালেভাবে ধুয়ে নিয়ে ঘরের তাপমাত্রায় ফ্যানের নীচে একরাত রাখার পর একটি শুস্কায়ন মেশিনে ৪৮ ঘন্টা শুকানো হয়। অতঃপর ইলেক্ট্রিক ব্লেন্ডারে ব্লেন্ড করে পাউডারের সাথে মিশ মিল, গমের ভুষি, চালের কুড়া, সরিষার খৈল, সয়াবিন মিল, গমের আটা, সয়াবিন তেল ও ভিটামিন এবং মিনারেলস প্রিমিক্স নির্দিস্ট মাত্রায় মিক্স করে খাদ্য বানানোর মেশিনে দানাদার খাদ্য তৈরি করা হয়। এই গবেষণায় তিনটি খাদ্য তৈরি করা হয় যথাক্রমে ০%, ১০% এবং ২০% পাট পাতার পাউডার যোগ করে, যা দিয়ে মৃগেল মাছের পোণা দুই মাস লালন পালন করা হয়। এই গবেষণার যার ফলাফল নিম্নে উপস্থাপন করা হল।

চিত্র ১- ল্যাবরেটরীতে পাট পাতা প্রক্রিয়াজাত করণ করে পাউডার উৎপাদন পক্রিয়া।

পাট পাতাজাত পাউডার মিশ্রিত খাদ্যের গবেষণাঃ


দুই মাসব্যাপী মৃগেল মাছের পোণার উপর গবেষণার পর দেখা গেছে যে তিনটি খাদ্যই মাছ ভাল ভাবে গ্রহণ করেছে। এই গবেষণায় কোন মাছ মারা যায় নাই। তবে মাছের দৈর্ঘ্য এবং ওজন বৃদ্ধি ঘটলেও তা তিনটি খাদ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভাবে পার্থক্য করা যায়নি। তিনটি খাদ্যের মধ্যে ১০% পাট পাতার পাউডার মিশ্রিত খাদ্যে মাছের দৈর্ঘ্য, ওজন এবং উৎপাদন বেশী হয়েছে, তারপরই রয়েছে ২০% পাট পাতার পাউডার মিশ্রিত খাদ্যের অবস্থান। এখানে শুধু মাত্র মিশ মিল মিশ্রিত খাদ্যের অবস্থান ছিল সর্বনিম্নে। অধিকন্তু, পরীক্ষায় সবচেয়ে কম খাদ্য ব্যবহার করে বেশী উৎপাদন পাওয়া গেছে ১০% পাট পাতার পাউডার মিশ্রিত খাদ্যের মাধ্যমে। মাছের দেহের আনুমানিক কম্পোজিশন পরীক্ষায় আরও দেখা গেছে ১০% পাট পাতার পাউডার মিশ্রিত খাদ্যের মাছের দেহে প্রোটিন, লিপিড, ফাইবার, ছাই এবং শর্করা বেশী থাকলেও তা পরিসংখ্যান গত ভাবে তাদের মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য সৃষ্টি করেনি। তবে খাদ্যের উৎপাদন খরচ বিবেচনা করলে দেখা যায় যে ২০% পাট পাতার পাউডার মিশ্রিত খাদ্যের উৎপাদন খরচ অত্যন্ত কম ছিল যা পরিসংখ্যান গত ভাবেও উল্লেখযোগ্য। সুতরাং দেখা যাচ্ছে ফেলে দেওয়া পাট পাতা ব্যবহার করে মৃগেল মাছের পোণার খাদ্য প্রস্তুত করে দুই মাস মাছ লালন পালন করে দেখা গেছে যদিও ১০% পাট পাতার পাউডার মিশ্রিত খাদ্যের মাছের উৎপাদনসহ বেশ কিছু উপাদান বেশী হলেও তা উল্লেখযোগ্যভাবে বেশী নয়। তাই খাদ্য খরচসহ সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিলে ২০% পাট পাতার পাউডার মিশ্রিত খাদ্যেই সর্বাপেক্ষা উত্তম বলে বিবেচিত হয়। আরও একটি বিষয় এই গবেশণার মাধ্যমে জানা গেছে যে যদিও ফিশ মিল মাছ চাষের মুল উপাদান হিসাবে বিবেচিত, তবে একমাত্র উপাদান নয় তা প্রমানিত। এখানে আমরা ফিশ মিলকে ২০% পাট পাতার পাউডার দ্বারা প্রতিস্থাপন করে প্রমাণ করতে পেরেছি যে ফেলে দেওয়া পাট পাতাও মাছ চাষের মুল্যবান উপাদান হিসাবে কাজ করে।

চিত্র স২- পাট পাতার পাউডার মিশ্রিত বিভিন্ন খাদ্যের উৎপাদন খরচ।

উপসংহারঃ


পাট শাক একটি গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি সমৃদ্ধ সবজি তা এই গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। পাট শাকে যে বিপুল পরিমাণ খনিজ লবণ যেমন পটাশিয়াম, আয়রন, ক্যালশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ফসফরাস, সেলেনিয়াম এবং ভিটামিন যেমন ভিটামিন সি, ই, কে, বি- ৬ এবং নিয়াসিন রয়েছে তা মাছের খাদ্যে যোগ হওয়ায় ফিশ মিল হ্রাস করেও মাছের ভাল উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। পাট শাকে আরও আছে এন্টিঅক্সিডেন্ট, ক্যারোটিন এবং খাদ্য আঁশ যা মাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়েছে, ফলে মাছের মৃত্যু হার রোধ করা সম্ভব হয়েছে। মাছের দেহের আনুমানিক কম্পোজিশন পরীক্ষায়ও দেখা গেছে ১০% পাট পাতার পাউডার মিশ্রিত খাদ্যের মাছের দেহে প্রোটিন, লিপিড, ফাইবার, ছাই এবং শর্করা বেশী ছিল যা পাট শাকের পুষ্টি গুণেরই ফলাফল যদিও এই বৃদ্ধি পরিসংখ্যান গত ভাবে কোন পার্থক্য ছিল না। এই গবেষণার মাধ্যমে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে ২০% পাট পাতার পাউডার দিয়ে ফিশ মিলকে প্রতিস্থাপন করে যে খাদ্য উৎপাদন করা হয়েছে তা গুণগত মান সম্পন্ন এবং দামে সাশ্রয়ী। তাই পাট পাতাকে না ফেলে দিয়ে তা মাছসহ গৃহ পালিত পশু পাখির সম্পূরক খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করে একদিকে যেমন খরচ সাশ্রয় করতে পারি অন্যদিকে পরিবেশকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে পারি।


লেখকঃ প্রফেসর ড. এম. এ. সালাম
একোয়াকালচার বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়