বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলসহ অনেক জায়গায় লবণাক্ত জমির পরিমাণ বেড়েছে। সাধারণ ফসল এসব জমিতে ভালো ফলন দিতে পারে না। তাই লবণ সহনশীল ফসলের চাষের দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। এর মধ্যে বাদাম, সূর্যমুখী, মুগডাল ও তরমুজ উল্লেখযোগ্য। এসব ফসলের চাষ লবণাক্ত জমিকে ব্যবহারের আওতায় আনতে যেতে পারে।
বাদাম চাষের সুবিধা ও সম্ভাবনা:
বাদাম একটি তেলজাত ও অর্থকরী ফসল। এটি লবণ সহ্য করতে সক্ষম এবং অল্প পানিতে চাষযোগ্য। মাটির গুণগত মান উন্নত করে ও নাইট্রোজেন ধরে রাখে। বাজারে উচ্চমূল্য ও চাহিদা রয়েছে। উপকূলীয় এলাকায় সফলভাবে বাদাম চাষের উদাহরণ পাওয়া গেছে। জাত: বিনা বাদাম -৪, BAU বাদাম -2, Dhaka-1 লোকাল জাত।
সূর্যমুখী চাষের সুবিধা ও সম্ভাবনা:
সূর্যমুখী একটি লবণ সহনশীল তেলবীজ ফসল। তুলনামূলক কম যত্নে ও স্বল্প খরচে ভালো ফলন হয়। প্রক্রিয়াজাত করে সূর্যমুখী তেল উৎপাদন করা যায় যা পুষ্টিকর। পতিত বা অল্প উৎপাদনক্ষম জমিতে সহজে চাষযোগ্য। ফসল ঘূর্ণিঝড় ও জলাবদ্ধতার কিছুটা প্রতিরোধ করতে সক্ষম। জাত: বারি সূর্যমুখী২,৩, হাইসান-৩৩, পারসিডান-৯৫।
মুগডাল চাষের সুবিধা ও সম্ভাবনা:
মুগডাল লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে এবং দ্রুত ফলন দেয়। এটি ডালজাত ফসল হিসেবে মাটিতে নাইট্রোজেন যোগ করে। পুষ্টিগুণে ভরপুর এবং স্বল্পমূল্যে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করে। শুষ্ক মৌসুমে চাষযোগ্য হওয়ায় সেচের চাপ কম পড়ে। অধিক ফলনের জাত (যেমন BARImung-6) লবণাক্ত জমিতেও চাষ করা যায়। জাত: বারি মুগ ৬,৭,৮,৯।
তরমুজ চাষের সুবিধা ও সম্ভাবনা:
উপকূলীয় লবণাক্ত এলাকায় তরমুজের বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা রয়েছে। এটি একটি উচ্চমূল্যের ও লাভজনক ফসল। বালুময় ও লবণাক্ত জমিতে চাষযোগ্য। কম খরচে উৎপাদন সম্ভব এবং দ্রুত অর্থনৈতিক মুনাফা আসে। বিদেশেও তরমুজের চাহিদা রয়েছে, ফলে রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। জাত: Sugar baby, Crimson sweet, Arka manik.।
কৃষি বিভাগের অগ্রগতি ও ভূমিকা:
উপকূলীয় লবণাক্ত এলাকায় কৃষিতে কৃষি বিভাগের অগ্রগতি ও ভূমিকা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই অঞ্চলে মাটির লবণাক্ততা, জলাবদ্ধতা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ কৃষিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কৃষি বিভাগ নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
লবণাক্ততা সহনশীল ফসল উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ:
গবেষণা ও উন্নয়ন: বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (BARI) এবং বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (BRRI) লবণাক্ততা সহনশীল ধান, গম, ডাল, সরিষা ইত্যাদির জাত উদ্ভাবন করেছে। যেমন: BRRI dhan-67, 84, 92 ইত্যাদি। ফসল বৈচিত্র্য: ধান ছাড়াও সূর্যমুখী, শসা, তরমুজ, বিভিন্ন শাকসবজি ও মিষ্টিকুমড়া চাষে কৃষকদের উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে।
আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি হস্তান্তর:
ভাসমান বেড/ধাপ চাষ: বন্যা ও জলাবদ্ধ এলাকায় সবজি উৎপাদনের জন্য।
ড্রিপ ও স্প্রিংকলার সেচ পদ্ধতি: পানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তির ব্যবহার। অর্গানিক ও লবণমুক্ত সার ব্যবহারে প্রশিক্ষণ।
কৃষক প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা: কৃষক মাঠ স্কুল (Farmer Field School): কৃষকদের আধুনিক চাষাবাদে প্রশিক্ষণ।
উপদেষ্টা সেবা: কৃষি উপ-সহকারী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে নিয়মিত পরামর্শ প্রদান।
অবকাঠামো ও সহায়তা: চাষযোগ্য জমি উন্নয়ন: খাল খনন, সেচ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন। সরকারি ভর্তুকি: বীজ, সার, কৃষি যন্ত্রপাতিতে ভর্তুকি প্রদান।
জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন: পরিবেশবান্ধব চাষাবাদ: জৈব সার, পরিবেশসম্মত পদ্ধতির ব্যবহার। জলবায়ু সহনশীল পরিকল্পনা: কৃষি কৌশল ও সময়সূচি পরিবর্তন করে ফসল উৎপাদন নিশ্চিত করা। উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষিতে কৃষি বিভাগের অবদান উল্লেখযোগ্য। তারা শুধু নতুন জাত উদ্ভাবনেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং প্রযুক্তি হস্তান্তর, কৃষক capacitation, এবং জলবায়ু অভিযোজন কৌশল বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ অঞ্চলের কৃষিকে আরও টেকসই ও উৎপাদনশীল করে তুলছে।
চ্যালেঞ্জ : বাংলাদেশসহ উপকূলীয় অঞ্চলে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সঠিক পানি ব্যবস্থাপনার অভাব এবং পানিতে অতিরিক্ত লবণাক্ততার সমস্যা। এই চ্যালেঞ্জ দুটি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
সঠিক পানি ব্যবস্থাপনার অভাব :
অপরিকল্পিত চাষাবাদ, জলাধার ও খাল-বিলের ভরাট, পানির অপচয়, এবং সমন্বয়হীন পানি ব্যবহার। কৃষিতে পানি সংকট, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হ্রাস, খরার প্রভাব বৃদ্ধি। সমাধান: পানি সংরক্ষণের জন্য ছোট ছোট বাঁধ, পুকুর ও খাল পুনঃখনন। সেচ ব্যবস্থায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার (যেমন: ড্রিপ ইরিগেশন)। কৃষকদের পানি ব্যবস্থাপনা বিষয়ক প্রশিক্ষণ।
অতিরিক্ত লবণাক্ততা: কারণ: সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ফলে লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়া, চিংড়ি চাষের জন্য লবণাক্ত পানি ব্যবহার। কৃষি জমি অনুর্বর হয়ে পড়া, সুপেয় পানির সংকট, স্বাস্থ্যঝুঁকি বৃদ্ধি।
সমাধান: লবণ সহনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবন ও চাষ। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে সুপেয় পানির উৎস তৈরি। লবণাক্ত পানির প্রবেশ রোধে বাঁধ ও বেড়িবাঁধ উন্নয়ন। সঠিক পানি ব্যবস্থাপনা ও অতিরিক্ত লবণাক্ততা মোকাবেলা একটি সমন্বিত উদ্যোগের দাবি রাখে। সরকার, স্থানীয় জনগণ এবং এনজিও মিলিতভাবে কাজ করলে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব।
লবণাক্ত জমিকে উৎপাদনশীল করতে হলে লবণ সহনশীল এবং উপযোগী ফসল নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ। বাদাম, সূর্যমুখী, মুগডাল ও তরমুজ চাষ এসব জমিতে কৃষকের আর্থিক উন্নয়ন, খাদ্য নিরাপত্তা এবং জমির ব্যবহারের পরিধি বাড়াতে সহায়ক। সরকার ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহযোগিতায় এ চাষ সম্প্রসারিত হলে দেশের উপকূলীয় কৃষি আরও টেকসই হবে।
লেখক: সমীরণ বিশ্বাস, কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ , ঢাকা।